মোস্তফা কামাল: এইচএসসির পাস অটো। শনিবার ফল ঘোষণার বহু আগেই তা ফাঁস হয়ে গেছে। কীভাবে এসএসসির ৭৫ শতাংশ এবং জেএসসির ২৫ শতাংশ মার্ক যোগ করে এইচএসসিতে অটোপাস দেওয়া হবে- সিদ্ধান্তটি জানানোর পরই ফলও জানা হয়ে গেছে ২০২০ সালের ১৩ লাখ ৬৭ হাজার ৩৭৭ জন পরীক্ষার্থীর। সবাই পাস করেছে। তাদের মধ্য জিপিএ-৫ (গ্রেড পয়েন্ট এভারেজ) পেয়েছে ১ লাখ ৬১ হাজার ৮০৭ জন। তা মোট পরীক্ষার্থীর ১১ দশমিক ৮৩ শতাংশ। গতবার জিপিএ-৫ পেয়েছিল ৪৭ হাজার ২৮৬ জন। তা মোট পরীক্ষার্থীর ৩ দশমিক ৫৪ শতাংশ।
নিবার রাজধানীর সেগুনবাগিচায় আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটে গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সে যুক্ত হয়ে এ ফল প্রকাশ করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এ সময় যুক্ত ছিলেন শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি।
বিশ্বের কোনো কোনো দেশের মোট জনসংখ্যাও এত নয়। অনেকের জানা নাও থাকতে পারে, ভ্যাটিকান সিটি বা তুভালোর জনসংখ্যা ১২ হাজারের বেশি নয়। বাংলাদেশের এবার এইচএসসি পাসের সংখ্যাই গ্রিনল্যান্ডের জনসংখ্যার ২৪ গুণ বেশি। দেশটিতে হালনাগাদ জনসংখ্যা ৫৬ হাজার ৮২৭। মোনাকোর জনসংখ্যা আরও কম- মাত্র ৩৭ হাজার। জিব্রাল্টায় ৩২ হাজার। আর ফকল্যান্ডের জনসংখ্যা সর্বসাকুল্যে ৩ হাজারের বেশি নয়। এসব দেশের সঙ্গে তুলনা না করলেও বাংলাদেশের এবার এইচএসসি উত্তীর্ণের সংখ্যাটি বিশাল। জনশক্তি বিচারে গুরুত্বময়।
গত বছর ১১টি শিক্ষা বোর্ডে এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষা দেওয়ার কথা ছিল ১৩ লাখ ৬৫ হাজার ৭৮৯ শিক্ষার্থীর। পরীক্ষা শুরুর রুটিন ছিল ২০২০ সালের ১ এপ্রিল। কিন্তু করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ বাড়তে থাকায় ১৭ মার্চ থেকে বন্ধ করে দেওয়া হয় দেশের সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। এর পর গত ৭ অক্টোবর সংবাদ সম্মেলন ডেকে পঞ্চম ও অষ্টমের সমাপনীর মতো এইচএসসি পরীক্ষাও বাতিলের সিদ্ধান্তের কথা জানান শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি। পরে জানানো হয়, দেওয়া হবে অটোপাস ও পাস নির্ধারণের মার্কিং পদ্ধতিও। কাজটির আইনি ভিত্তি দেওয়া হয়েছে পোক্তভাবে।
নানা আনুষ্ঠানিকতা শেষে ২৫ জানুয়ারি রাতে পরীক্ষা ছাড়াই এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষার ফল প্রকাশ করতে সংসদে পাস হওয়া তিনটি সংশোধিত আইনের গেজেট জারি করা হয়। সেদিন সন্ধ্যায় রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ তিনটি বিলে সম্মতি দেন। বিল তিনটিতে রাষ্ট্রপতির সম্মতির পর সেগুলো আইনে পরিণত হয়। এর পর গেজেট প্রকাশ শেষে শনিবার ঘোষণা হলো ফল। এর মধ্য দিয়ে ফলটিই কেবল আইনসিদ্ধ হলো না, ভবিষ্যতেও কোনো দুর্বিপাকে পড়লে এ আইন অনুসরণ করা যাবে।
এইচএসসিতে অটোপাসের ফল ঘোষণার দিনকয়েক আগে থেকে ২০২১ সালের এসএসসি পরীক্ষাও না নিয়ে অটোপাসের দাবিতে আন্দোলনের টোকা পড়েছে। দেশের কোথাও কোথাও মানববন্ধনের খবরও আসছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে ‘করোনার মধ্যে এসএসসি নয়’ নামে একটি গ্রুপও সক্রিয়। আন্দোলন চড়া না হলেও তাদের পক্ষেও যুক্তি বড় কড়া। বলা হচ্ছে, তাদের দশা এইচএসসি পরীক্ষার্থীদের চেয়েও খারাপ। স্কুল বন্ধ ১০ মাস। এই ১০ মাসে তারা স্কুলের ধারেকাছেও যায়নি।
মোট কথা, ২০২০ সালের এইচএসসি পরীক্ষার্থীদের চেয়ে অটোপাসের বেশি হকদার তারা। এমন আবদার সরকার থেকে এরই মধ্যে নাকচ করে দেওয়া হয়েছে। তা হলে কী হবে তাদের ক্ষেত্রে? ওই সুযোগ থাক, না থাক; দেওয়া হোক, না হোক- লোভ কিন্তু জেগেছে। বিবেচনায় রাখতে হবে বিষয়টি। ‘পরীক্ষার বিকল্প পরীক্ষাই’ হবে। কেমন হবে ওই পরীক্ষাটি- এ প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে। এর চেয়েও আপাতত জরুরি হচ্ছে উচ্চশিক্ষা পর্বে ভর্তি নিয়ে। শিক্ষামন্ত্রী খোলাসা করেই জানিয়েছেন, এইচএসসিতে পাস অটো হলেও বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তিতে তেমন কিছু আশা করার সুযোগ নেই। এর চেয়েও জরুরি প্রশ্ন হয়ে দেখা দিয়েছে, বিশাল এই সংখ্যক উচ্চমাধ্যমিক উত্তীর্ণের পরবর্তী অভিযাত্রা মানে উচ্চশিক্ষায় ভর্তি নিয়ে। সামনেই মেডিক্যাল, ইঞ্জিনিয়ারিং ছাড়াও বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পর্ব। এ অটোপাসরাই ক্যান্ডিডেট। তাদের প্রতি অবজ্ঞা কাম্য নয়। আবার তারকাখ্যাতির সুযোগও কম। মহামারীর কারণেই অটোপাসের সুযোগ বা কলঙ্ক। এটিকে অবিমৃশ্যকারী ও অদূরদর্শী, তুঘলকিসহ নানা কথা থাকলেও চলমান এবং হাল পরিস্থিতিতে এর বিকল্প ছিল না।
অভিভাবকরা নিশ্চয়ই করোনা প্রকোপের মধ্যে সন্তানদের ঠেলে দিতে চাইবেন না। আবার যতই বলা হোক- আগে জীবন, পরে শিক্ষা; সন্তানের পড়াশোনা বেশিদিন বন্ধ থাকাও কষ্টের। দুই ধরনের ঘটনার দৃষ্টান্তই রয়েছে। উন্নত অনেক দেশে এখনো স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ। পরীক্ষা দেওয়া-নেওয়া আরম্ভ হয়নি। কোথাও কোথাও চালু হলেও আবার বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এর মানে এই নয় যে, তাদের আমাদের অনুসরণ করতে হবে। তারা কোন যুক্তিতে বন্ধ রেখেছে অথবা খুলে আবার বন্ধ করেছে- দুটিই বিবেচনায় নিতে হবে। বর্তমান পরিস্থিতি গোটা বিশ্বের জন্য নতুন ও প্রায় অভিন্ন। তবে বিচ্ছিন্নভাবে ব্রেক অব স্টাডি, পরীক্ষা স্থগিত, ফলাফল বাতিল, সেশনজট ইত্যাদির সঙ্গে এ অঞ্চল বেশ পরিচিত। তা কেবল পরাধীন দেশে নয়। স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশেও।
১৯৪৭ সালের দেশ বিভাগের সময় যারা ডিগ্রি পরীক্ষার্থী ছিলেন, তাদের বিনা পরীক্ষায় সার্টিফিকেট দেওয়া হয়েছিল। পরে স্নাতকোত্তর শ্রেণিতে ভর্তি হতে তাদের কোনো সমস্যা হয়নি। লোকে তাদের ‘পার্টিশন গ্র্যাজুয়েট’ বলে বিব্রত করত। ১৯৬০ সালের জানুয়ারি থেকে ১৯৬১ সালের জুন পর্যন্ত ১৮ মাস এ অঞ্চলে ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়তে হয়েছিল শরিফ কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী জানুয়ারি-ডিসেম্বরের পরিবর্তে জুলাই-জুন সেশন পরিবর্তনের কারণে। ’৬১-তে আইয়ুব খানের মত পাল্টালে জানুয়ারি-ডিসেম্বর সেশনে ফিরতে তাদের সপ্তম ও অষ্টম শ্রেণিতে পড়তে হয়েছিল মাত্র নয় মাস করে। ১৯৬২ সালের ডিসেম্বরে অষ্টম শ্রেণির বার্ষিক দিয়ে আবার ফিরতে হয় আগের নিয়মে। ওই সময়টায় মাঝখান থেকে একটি ব্যাচের ডিগ্রি তৃতীয় বর্ষকে ‘অটোপাস’ দেওয়া হয়। বিএ, বিএসসি ও বিকম হয়ে পরে তাদের গঞ্জনা সইতে হয়।
ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের বছরের ক্যারিকেচারও এ দেশের শিক্ষাজগতের ইতিহাসের অংশ। সত্তরের নির্বাচনের আগে-পরের ঘটনাও অনেক। একাত্তরের কাহিনি ঊল্লেখের অপেক্ষা রাখে না। বাহাত্তরের ঘটনা চরম কলঙ্কের। ৯ মাসের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় ১৯৭২ সালে স্বাধীন বাংলাদেশে অটোপাস দেওয়া হয়। একাত্তরের প্রতিটি পাবলিক পরীক্ষা হয় বাহাত্তরে। এরই মধ্যে সৃষ্ট সেশনজট এড়ানোর জন্য ১৯৭৫ ও ১৯৭৬ সালের উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ দুটি ব্যাচকে একত্রিত করা হলেও বিশ্ববিদ্যালয়ের সেশনজটের গ্রিডলক থেকে বেরিয়ে আসতে সময় লেগেছে দীর্ঘ দুই যুগ। আজও অবজ্ঞা-তাচ্ছিল্যের নাম বাহাত্তরের পাস।
আগের নজির আমলে রেখে বলতে হয়, উচ্চমাধ্যমিকে যা হওয়ার হয়ে গেছে। এর নিচে-উপরে মোট কথা কোনো পর্বেই কলঙ্ক-অবমাননা এড়াতে হবে। শিক্ষার্থীদের পথচলায় অমন বিতর্কের কাঁটা না পড়ুক। বাহাত্তর-টোয়েন্টি ধরনের নামে চিহ্নিত না হোক কেউ। শনিবারের উত্তীর্ণরা মঙ্গলের দিকে যাবে, বৃহস্পতি তুঙ্গে নেবে বিশ্ববিদ্যালয় মাড়িয়ে। প্রশ্ন ফাঁসসহ নানা কারণে বেসরকারি চাকরিদাতাদের এসএসসি ও এইচএসসির মতো পরীক্ষার প্রতি আগ্রহ আগে থেকেই কম। তবে সরকারি চাকরিতে পাবলিক পরীক্ষার ফলটাকে গুরুত্ব দিয়ে দেখা হয়। বেসরকারি চাকরিদাতারা মূলত দেখেন সে কোন ইউনিভার্সিটিতে পড়ালেখা করেছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের ফল কেমন, ইন্টারভিউতে কেমন করল। শিক্ষার্থীরা বিকল্প মূল্যায়নের কারণে ভালো ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হতে না পারলে ভবিষ্যতে পস্তাবে। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে মেধার স্বাক্ষর রাখতে পারলে বিশের বিষ অবশ্যই কেটে যাবে।
সামনে নতুন কথা বা নতুন কোনো সিদ্ধান্ত না এলে এখন পর্যন্ত বলা যায়, উচ্চশিক্ষা পর্যায়ে ভর্তির ক্ষেত্রে পরীক্ষা নেওয়া হবে। সেটা হবে গুচ্ছ পদ্ধতিতে। এখন পর্যন্ত মাত্র ৪টি বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়া বাকি সব বিশ্ববিদ্যালয় গুচ্ছ পদ্ধতিতে পরীক্ষার ব্যাপারে সম্মত হয়েছে। গুচ্ছ পদ্ধতিতে যাওয়ার তাগিদটি অনেকদিনের। কয়েক বছর ধরে আলোচিত হলেও করোনা পরিস্থিতিতে বেশি প্রাসঙ্গিক। এতে শিক্ষার্থীদের হয়রানি কমবে। অভিভাবকদের কষ্ট কমবে। আর্থিক সাশ্রয় হবে। মহামারীর সংক্রমণ ঝুঁকি নিয়ে লাখ লাখ শিক্ষার্থী-অভিভাবককে সারাদেশে ছুটে বেড়াতে হবে না। উচ্চশিক্ষার প্রবেশদ্বারে এসে একটু হলেও ভালো স্বপ্ন দেখুক তারা।
মোস্তফা কামাল : সাংবাদিক-কলাম লেখক; বার্তা সম্পাদক, বাংলাভিশন